পাড়া-প্রতিবেশীদের মিষ্টি খাওয়ানো দূরের কথা, যেদিন মোহাম্মদ আলীর জন্ম, সেদিন পরিবারের কারও মুখে হাসি ফোটেনি। তাঁকে একনজর দেখতে আসা প্রতিবেশীরাও মন খারাপ করে চলে যান। এমন ছেলে জন্ম দেওয়ায় আলীর মাকে স্বজনেরা কম অপবাদ দেননি। নীরবে শুধু চোখের জল ফেলেছেন তিনি। তবে মায়ের কষ্ট বুঝতে বেশি সময় নেননি আলী। পাড়ার অন্য ছেলেরা যখন পেনসিল দিয়ে লেখা শিখতে শুরু করে, তখন একই কাজে পা ব্যবহার করতে হয়েছে আলীকে! দুই হাত না নিয়েই যে জন্মেছেন তিনি।
হাত না থাকাটা স্কুলজীবনে বড় বাধা হতে পারেনি আলীর কাছে। পা দিয়ে লিখেই এসএসসি ও এইচএসসির গণ্ডি পেরিয়েছেন তিনি। এসএসসির ফল একেবারে খারাপ করেননি। এ গ্রেড (জিপিএ-৪) পেয়ে কলেজে ভর্তি হন। এখন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়ছেন। প্রতিনিয়ত তাঁকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছেন মা শামসুন্নাহার বেগম।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের হরিদাঘোনা গ্রামে আলীর বাড়ি। তাঁর মা শামসুন্নাহার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে দুটি হাতছাড়া জন্ম নেওয়ায় খুবই কষ্ট পান। সবাই এমনভাবে তাকাতেন যেন সব দোষ তাঁর। অন্য ছেলেমেয়েরা যে বয়সে স্কুলে পড়তে যায়, আলীকেও সেই বয়সে স্কুলে পাঠাবেন বলে ঠিক করেন তিনি। কিন্তু এলাকার কোনো স্কুল আলীকে ভর্তি করাতে চায়নি। পরে ইউনিয়নের উত্তর বড়হাতিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী তাঁর ছেলেকে ভর্তি করাতে রাজি হন। এখন পা দিয়েই আলী মোবাইল ফোন, কম্পিউটার চালাতে পারে।
আলীকে স্কুলে ভর্তি করানোর স্মৃতি স্মরণ করে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘যখন দেখি পা দিয়েই ছেলেটা ইংরেজি ও বাংলা অক্ষর লিখতে পারে, তখন স্কুলে ভর্তি করি। সে নিয়মিত স্কুলে আসত। দুটি বেঞ্চ পাশাপাশি লাগিয়ে তার পরীক্ষা নিতাম। প্রতিবন্ধী বলে কোনো অতিরিক্ত সুযোগ সে পায়নি। পা দিয়ে হাতের চেয়ে দ্রুত ও সুন্দরভাবে লিখতে পারত আলী।’
আলীর প্রতিবেশী আবদুল মতলব বলেন, মা-ছেলে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তাঁরা দুজন এখন এলাকার অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা।
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট আলী। অন্যরা কেউই এসএসসি পাস করতে পারেননি। বড় ভাই জিয়াউর রহমান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। কিছুদিন আগে সৌদি আরবে গেছেন। তাঁর বাবা আমিন শরিফ সাত বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। বড় বোন চম্পা আক্তার নবম শ্রেণি এবং মেজ বোন রীমা আক্তার এসএসসি পর্যন্ত পড়েছেন।
আলী এসএসসি পাস করেছেন লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া বি জি সেনের হাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নাজিম উদ্দিন জানান, পা দিয়ে লিখলেও আলীর লেখা খুব পরিচ্ছন্ন।
পায়ে লিখে পরীক্ষা দিলেও স্কুলে অনেকের চেয়ে আলীর ফল ভালো ছিল বলে জানান তাঁর বন্ধু জনি সূত্রধর।
আলীর লেখাপড়ায় সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহাবুব আলম।
নিজের চেষ্টার বিষয়ে আলী বলেন, ‘মা সব সময় চান লেখাপড়াটা যাতে কিছুতেই না ছাড়ি আমি। আট বছর বয়সেই পা দিয়ে বাংলা ও ইংরেজি অক্ষর লেখা রপ্ত করে ফেলি। দুই হাত নেই বলে কোনো দিন যাতে আক্ষেপ না করি, সেটা ছোট থেকেই বোঝাতেন মা। তবে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলাধুলা করতে পারতাম না বলে খুব খারাপ লাগত।’
জীবনের লক্ষ্য জানতে চাইলে আলী বলেন, মাস্টার্স শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে চান তিনি।
- Get link
- X
- Other Apps
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment