প্রত্যাশা ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে গিয়ে আমরা আরও অনেকটাই ভালো খেলব। মুশফিকের দল, মাশরাফির দল বা সাকিবের দল হারতে হারতে জিতবে, জিততে জিততে হারবে, লড়াই করবে। তেমনটা হয়নি, যা আমরা চেয়েছিলাম। এই চাওয়াটার পেছনে অনেকটাই যুক্তিনির্ভর স্বপ্নের তাগিদ ছিল।
সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোতে আমাদের ক্রিকেটীয় অর্জনগুলো আমাদের সাফল্যতৃষ্ণা এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের নিজের মাঠে অন্য দলগুলো আমাদের যেভাবে প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে, তার নিরিখে আমাদের বিদেশের মাটিতে জেতার আগ্রহ এখন একটা পরিষ্কার অবয়ব পেয়েছে। সে আগ্রহের উড়াল বিঘ্নিত হলে আমরা ব্যথিত হই। নিজেদের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনার ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিই। বিবেচনায় নিতে চাই না প্রতিপক্ষের খেলাটি নিয়ে দাপুটে উত্তরাধিকার। ঘরের মাঠে আমরা যেমন প্রাধান্যবিস্তারী আবহ নির্মাণে সরগরম হয়েছি, তেমন ব্যাপারটা ওদেরও আছে। এসব আমরা বুঝি না যে তা নয়। তারপরও আমরা জয় চাই এবং না পেলে ব্যথিত হই।
এই চাওয়াটা বা এই আশাহত বেদনার আওতায় প্রবেশ আমাদের ক্রিকেটীয় মানসিকতার একটা অবস্থান। এটাও আমাদের অর্জন করতে হয়েছে দীর্ঘ চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে। একটু একটু স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে আমরা বড় স্বপ্নের আওতায় ঢুকেছি। যে বিশ্ব ক্রিকেটের এক কোণে জায়গা পাওয়ার জন্য আমাদের চরম আকুলিবিকুলি ছিল দৃষ্টিগোচর নিকট অতীতেই, সেই বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করার ইচ্ছাটা এখন সাহসী পেখম মেলেছে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ডি ভিলিয়ার্স, আমলা, রাবাদাদের সঙ্গে লড়াইহীন পরাজয়ে আমাদের ক্ষোভ জাগে। আত্মবিশ্লেষণে, কার্যকারণের শিকড় সন্ধানে আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি। খেলোয়াড়দের প্রতি হাপিত্যেশি নির্মম বাক্যবাণ ছুড়ে দিই। সহমর্মিতার অবস্থান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সরে যাই আবার ফিরে আসার আগ্রহে।
তাই বলছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার সফর নিয়ে আমাদের যে নৈরাজ্য, যে গ্লানিবোধ, সেটা বছর কয় আগেও আমরা স্বাভাবিকভাবেই নিতাম। এখন নিতে পারছি না। এই নিতে না পারাটাই একটা বড় মাপের মানসিক অর্জন। এই বোধের জায়গায় আমরা পৌঁছেছি আমাদের ক্রমেই বড় হওয়া, প্রবল হওয়া গত দিনগুলোর ক্রিকেট ও ক্রিকেট ভাবনা নিয়ে। আমাদের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার ফলাফল যদিও নানা করণীয়র নির্দেশ দিয়ে বিচলিত করে, তবু চাহিদা পূরণ না হওয়ার বেদনাটা একই সঙ্গে ভিন্ন ধরনের এক প্রাপ্তির পরশ দিয়ে যায়। আমরা এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে, অস্ট্রেলিয়া বা অন্যান্য দেশে গিয়ে জিততে চাই। এর মধ্যে কোথাও কোথাও জিতেছিও। এই বিদেশের মাটিতে জিততে চাওয়ার প্রাবল্য তো একধরনের অর্জন।
নিজ আঙিনায় আমরা আজ যেমন দাপুটে চেহারা নিয়ে খেলছি, সেখানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে। আরেকটু রয়ে-সয়ে এগোই, বিদেশেও প্রবল হয়ে উঠব। শুধু লক্ষ রাখতে হবে পিছিয়ে যেন না পড়ি, অগ্রযাত্রা যেন ক্রমেই মসৃণতার দিকে যায়। পিছিয়ে পড়ার আলামত দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেই যেন মুছে ফেলতে যত্নবান হই। ক্রিকেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করার উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি আছে ঐতিহ্যকে বা ক্রমোন্নতির ধারাকে ধরে রাখতে না পারার করুণ আখ্যান। আমাদের সাবধানে পথ চলতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটের অযত্ন, সাংগঠনিক অসততা, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার কূটকৌশলী বিন্যাস, ক্রিকেট কেন, যেকোনো খেলারই অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে। ক্ষেত্রবিশেষে অতলে তলিয়ে দেয়। আমাদের একটু চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে। ওই সব আত্মবিধ্বংসী আলামতের অপছায়া যেন আমাদের স্বপ্নপথের উড়াল না থামায়।
- Get link
- X
- Other Apps
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment